ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডে প্রমাদবাবুর কলকাতা যাওয়ার আগের লেখা এখনো আছে, “the law of conservation of energy states that the total energy of an isolated system remains constant ………..”
***
প্রমাদবাবু পদার্থবিদ্যার শিক্ষক। প্রমাদ বোম। অবশ্য সে নামটা ছাত্ররা ছাড়া বিশেষ কেউ জানে না – প্রসাদ বোস বলেই জানে। যেদিন প্রথম ব্ল্যাকবোর্ডে “কুলম্বের মূত্র” লিখেছিলেন, সেদিন থেকেই ছাত্রদের কাছে তিনি প্রমাদবাবু। “স” কে অনেকটা “ম” এর মত লেখেন বলেই এই মুখ্যাতি। থুড়ি, সুখ্যাতি। পরের দিন থেকে যাবতীয় সূত্র তিনি ইংরেজিতে লেখা শুরু করলেন, কিন্তু নামটা থেকেই গেল.
প্রমাদবাবু পন্ডিত মানুষ – অন্তত তাঁর নিজের তাই ধারণা। বলেন, “মার্ক্স একেবারে গুলে খেয়েছি রে.” তবে এই পান্ডিত্যের ব্যাপারে পটলের দিদা একমত নন. তিনি বলেন, “বাবা পেসাদ, মার্ক পড়েছ, পড়েছ। একটু বিবেকানন্দের লেখাগুলোও নেড়েচেড়ে দেখলে পারতে। ক্ষেতি তো কিছু ছিল না.”
প্রমাদবাবু বলেন, “মাসিমা, পড়ার বইয়ের তো শেষ নেই. তারই মধ্যে বেছেবুচে যা মানব সচেতনতাকে জাগিয়ে তোলে, উদ্বুদ্ধ করে, তাই পড়া উচিত। এঙ্গেলস থেকে ইয়েচুরি, সবাই কি বলেন জানেন মাসিমা, ……”
পটলের দিদার কাছে বিবেকান্দর বাইরে সবই বিদেশী। তিনি থামিয়ে দেন, “রাখো বাপু তোমার বিদেশী লোকেদের কথা. দেশের লোকের লেখা কোনো বইই কি তোমার ভালো লাগে না? যদি ফিলোজপিই পড়বে তো একেবারে গোড়ার থেকে শুরু করো না বাপু, সেই বেদান্ত থেকে”
“মাসিমা, কাকে বিদেশী বলছেন! আমরা সবাই বিদেশী এই দেশে। এই যে ভারত ভারত বলে সবাই চেঁচায়, এরা এসেছে তো হাজার তিনেক বছর আগে – এসে স্থানীয় সভ্যতা ধ্বংস করে, লোকেদের মেরে, এখানে বসতি করেছে। আর আপনার বেদান্ত? সে কি ভারতের? নাম করা ঐতিহাসিকরা বলেন সংস্কৃত ভাষা আর বেদ সব এসেছে সিরিয়া জর্ডান থেকে।”
“কে নাম করা লোক বলে এসব? এই তো গহনানন্দ মহারাজ এসে বলে গেলেন, আমাদের ভারত থেকেই সব জায়গায় সভ্যতা ছড়িয়েছে।”
“হাসালেন মাসিমা। আমি বলছি ইয়েচুরি আর আপনি বলছেন কে গহনান্দ।”
“গহনান্দ নয় বাবা, গহনানন্দ। বেদান্তের বড় পন্ডিত।”
“বেদান্তের পান্ডিত্য দিয়ে যদি পৃথিবীর দারিদ্র দূর হত, তবেই সেই পন্ডিত হওয়া সার্থক। যে বেদান্ত শ্রমজীবীদের অপমান করে সে বেদান্তে আমার স্পৃহা নেই. যে বেদান্ত বলে মুসলিম মানুষদের মারো, সে বেদান্ত আমার নয়. আমার তো লজ্জা হয় নিজেকে ভারতীয় বলতে, লজ্জা হয় আমার পূর্বপুরুষদের বর্বরতায়।”
“এ সব কি বলছো বাবা? তুমি কোন বেদান্তে এ সব পেলে?”
কিন্তু এই সব বেদান্ত আর বিবেকানন্দ আওড়ানো প্রতিক্রিয়াশীল লোকেদের কথায় বেশি কান দিতে গেলে কাজের কাজ কিছুই হবে না. প্রমাদবাবু যে সমাজবাদী সুখী বিশ্বের লক্ষ্যে একনিষ্ঠ কাজ করে চলেছেন, তার আসন্ন পরবর্তী পদক্ষেপ হল ভারতীয় সাম্যবাদী দলের এক অনুষ্ঠানে কলকাতায় যাওয়া। কলকাতায় Eliminate Poverty and Starvation নামে বিরাট এক অনুষ্ঠান হতে চলেছে। দেশ বিদেশ থেকে নানান পন্ডিত মানুষ আসবেন যাঁরা প্রমাদবাবুর ভাষায়, “মার্ক্সের ব্যাপারে এক এক জন authority.”
পলাশপুর ইস্কুলে শিক্ষকতা করে বেশি রোজগার হয় না. তার ওপর সাম্যবাদী দলের তহবিলে সম্প্রতি নিজের যাবতীয় সঞ্চয় উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন প্রমাদবাবু। সেই পয়সায় যদি পৃথিবী থেকে দারিদ্র দূর করা যায়, তাহলে ছেলে অবিনাশ একবেলা না খেয়ে থাকলেও প্রমাদবাবুর দুঃখ নেই.
ছেলের জন্মের পর প্রমাদবাবুই নাম রেখেছিলেন অবিনাশ – যেমন অবিনাশ তাঁর দর্শন, যেমন অবিনাশ মহান মার্ক্সবাদ। কিন্তু ছেলে অবিনাশ হলেও, তার মা সাম্রাজ্যবাদের মতই ক্ষীণজীবী ছিলেন। অবিনাশের মা প্রায় বিনা চিকিৎসায় সামান্য রোগে মারা যান. বুর্জোয়া ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাননি প্রমাদবাবু। স্ত্রীর মৃত্যুর পর একটা ব্যাপার নিয়ে একটু দ্বিধায় পড়েছিলেন তিনি – মৃতদেহ সৎকার! প্রতিক্রিয়াশীল মানুষদের মত তিনিও কি শ্মশানে যাবেন, না ……….. প্রগতিশীল মানুষের কি করা উচিত সে ব্যাপারে কোনো বিধান দেওয়া নেই কোথাও! গুলে খাওয়া মার্ক্স্ বমি করে – থুড়ি, আবার পড়ে – কিছু না পেয়ে শেষে রফিকুল ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে গোর দিলেন। বলা বাহুল্য, সেদিন থেকে আর কোনো আত্মীয়ের সঙ্গে আর যোগাযোগ রইলো না. পলাশপুরে কিছু কানাকানি চললেও, কিছুদিন পর লোকে ভুলেই গেল এ সব. অবশ্য সাত বছরের অবিনাশ ভুলল কি না বলা যায় না. তবে একবেলা খেয়ে আর একবেলা কেঁদে তার দিন চলতে লাগল।
এমতাবস্থায় পলাশপুর থেকে কলকাতা যাওয়ার খরচ, কলকাতায় থাকার খরচ, আর কলকাতায় খাওয়ার খরচ জোগাড় করা আমেরিকায় সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করার থেকেও কঠিন। ভোটের আগে যে মিটিং-মিছিল হয়, তাতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ট্রাক আসে, ট্রাক বোঝাই করে ভোর বেলা নিয়ে যায়, আবার পরের দিন দুপুরে নামিয়ে দিয়ে যায়. কিন্তু দারিদ্র দূরীকরণের আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান বলে কথা – এখানে ট্রাক বোঝাই লোক নিয়ে যাওয়ার বদলে হয়ত সেই পয়সায় কোনো গরিব দেশের জনগণের দুবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করছে সাম্যবাদী দল! তাছাড়া, ট্রাকে করে যেতে অবিনাশ বড় কাঁদে – বলে ভিড়ের চাপে নিঃস্বাস নিতে পারে না নাকি। কাজেই যা দু-পয়সা আছে তাই দিয়ে ট্রেনে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন তিনি।
ট্রেনে যাওয়া হল, খাওয়া হল না. আগের দিন সকালের পর থেকে খাওয়া হয় নি যাওয়ার উত্তেজনায়। তার ওপর ষ্টেশন থেকে প্রায় তিন ঘন্টা হেঁটে অনুষ্ঠানের জায়গায় পৌঁছে প্রমাদবাবু দেখলেন দুটি জিনিস নেই – তাঁর মানিব্যাগ নেই, আর কোনো অনুষ্ঠান মঞ্চ নেই. মানিব্যাগ কোথাও কেউ তুলে নিয়েছে পকেট থেকে। আর মঞ্চ নেই মানে মিটিং-মিছিলের মতো বরাদ্দ ডিম্-পাউরুটি-কলাও নেই. তাছাড়া ডিম্ কলা দেবেই বা কে? অনুষ্ঠানের জায়গাটা তো আসলে একটা বিরাট হোটেল।
প্রমাদবাবু একটু ধাক্কা খেলেন – এইভাবে কি সাম্যবাদী দল পয়সা নষ্ট করছে? তবে নাও হতে পারে – হয়তো কোনো বড়লোক মানুষ এখানে অনুষ্ঠান করার পয়সা দিয়েছে। হয়তো মিটিং মিছিল-এর মত খাবার না দিয়ে ভেতরে ভালো আয়োজন করা হয়েছে দরিদ্র লোকেদের জন্যে! খাবার! ২২ ঘন্টা অনাহারের পর খাওয়ার কথা ভাবতেই খিদে পেলো জোর. অবিনাশকে নিয়ে প্রমাদ বাবু এগোলেন কাঁচের দরজার দিকে।
প্রমাদবাবু আবার ধাক্কা খেলেন – এবার দারোয়ানের কাছে। তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করতে আরেকটু ধাক্কাধাক্কি হল শুধু। শেষে বাপ্-বেটাকে ফুটপাথে ঠেলে বার করে দেওয়া হল. অপমানে আর ক্লান্তিতে সেখানেই আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লেন প্রমাদবাবু।
***
ঘুম থেকে উঠে প্রমাদবাবু ফিরেছিলেন একা. হোটেল থেকে থানা, সেখান থেকে স্টেশন – ট্রেনে টিকিট ছাড়া উঠে, কোনমতে চেকারকে এড়িয়ে পলাশপুর। বাড়ি যান নি, ইস্কুলে ফাঁকা ক্লাসরুমের মধ্যে পাথরের মত বসেছিলেন।
হয়ত ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতেন, “The law of social conservation states that the collective weight gained by the participants after the sumptuous dinner at the Eliminate Poverty and Starvation event is approximately equal to the weight of the scavenging child behind the pantry, beaten to death by the police!”